সরোদ বাজছিল। সরোদ এসেছে রাবাব থেকে। শুনেছি, জানিনা। সরোদ পার্সিতে মেলোডির মানে বয়ে চলে।
সামনের জলচল খালটি বইছে না।
নারীটি বইছে না। নাকি বইছে?
শূণ্যে স্থির হয়ে আছে কার আকাশবাড়ি?
সতত ঈশ্বর তুমি চাঁদের আশেপাশেই থাকো,
নাকি অন্যে আবাস তোমার আভাসে প্রকাশো?
আমার এত এত জিজ্ঞাসা!
আমার সারা জীবন শুধু জিজ্ঞাসা।
অথচ…। আ
আমি নারীটিকে জানতে চেয়েছিলাম
জিজ্ঞাসার মধ্যে নারীর মধ্যে যাইনি এবং
জিজ্ঞসাকে ধ্রুপদী গদ্যের মতন করে
আন্দোলন করিনি মর্যাদাময়
আমাদের মধ্যকার শূণ্যতায়।
কাল রাতে ওরা সব এসেছিল।
কাল রাতেও ওরা সব সরোদ শুনেছিল।
কাল রাতে ওরা সব খুব
মদ, মাতাল, নারী, পুরুষ,
দোলের অগ্রিম চাঁদ অমিয়-অমিয়া।
কাল সরোদে দেশ বেজেছিল আমি
খবরিয়া ছিলাম বলে জানি আজ।
কাল ওরা সবশেষ বিষ।
আমি আজ কামড় দেখছি।
মেয়েটি সরোদে বেসেছিল,
সরোদিয়া ভেসেছিল আঙুলে আঙুলে
গরিমা-কড়িমা অনিশ্চিত বিপন্ন দ্রাঘিমায়
কারো হাতে কোনো ম্যাপ ছিল না কলম্বাস,
নতুন বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ধৌত-চিত্তশুদ্ধি
প্রকল্পের মাঝে অযথাই ওদের খেয়েছে।
কেউ কি কাউকে প্রেম?
কারোর কি তারে প্রেম?
আঙুলে মোহ? শব্দে মুগ্ধতা?
কেউ চোখের অন্ধকারে সকল
আলো খুইয়ে দেশ সাধছিল?
বড্ড বিষ!
ওরা খেলতে এসেছিল রবীন্দ্রনাথের মাঠে।
রবীন্দ্রনাথের দলে ছিল কেউ কেউ নির্দল কি না
তাও জানেনা শুধু বসন্ত জানে
উদ্যত কপালের কাছে কালো ছোবল।
ওরা সব কলকাতা-শান্তিনিকেতন ঠাকুর।
আমার ক্লিন্ন প্রতিমা অলঙ্কারের
শৈলীতে আবদ্ধ আমার ক্রোধ,
আমার ক্রোধ,
আমার ক্রোধ।
নারী দিবস।
আমি দিবসে গোঙানু কানু,
পিরিতি শোঁচলু—
দোলের রাতে শেষ নিশ্চই দিবস?
নারী দিবস, তুমি কি শেষ?
অনিঃশেষ কে, কি কেন ও সন্দর্ভে
রটিল রমণাকাঙ্খা জটিল।
ও জটিলা
তরপিত দিবস,
অশেষ রভস
রাত্রি আসিলা।
ছেলেমেয়েরা খেলতে এসেছিল। ছেলেরা ছেলে। ছেলেরা ইস্কুলের ছাত্র পুরুষ গঠনের কারখানায়। মেয়েরা মেয়ে, মা, প্রেমিকা, বান্ধবী, সহচরী, কুটিলা-জটিলা-কামকলা। নারী, দিবস কেন? কেন নারী রাত্রি নয়? কেন কোনো দিবসকে রাত্রি বলে আমি ডাকিনি কখনো? আমি শ্রমের, প্রেমের সবের শুধু দিবস জেনেছি, জানানো হয়েছে।
রাত্রি?
অথৈ রাত্রি কই যাবে মহামহোপাধ্যায়?
এই যে রাত্রি বন্যার মতন বইছে আমার
চতুর্ষ্পার্শের ঘূর্ণনে, যে রাত্রি মহাসমাগতা
প্রাচীনা চাঁদের ধবধবে থোকা থোকা আলো
কোল পেতে নিয়েছে খোয়াই-এ,
এ কি নারীর না?
এ কি কেউ না?
কাল অথচ রাত্রিতেই
সব প্রকাশ এবং গোপন।
কাল সরোদের দেশ রাগ দেশের মতন খন্ডিত সমাবেশকে বিফলে।
নারীটি কলকাতা থেকে। ছেলেটি আরো দূর। নারীটি বাড়িতে সন্তান দুই, তার বন্ধু পুরুষ রেখে। ছেলেটি নাড়া বেঁধে শিখতে শিখতে সরোদের বদান্যতায় সরোদ বিলোচ্ছিল খাল-পাড়ে। জড়ো কিছু মানুষ, লিঙ্গে বিভাজিত বলে পরস্পরের গন্ধকে সন্দেহ করেছে। ছেলেটির সরোদ আর নারীটির আকুল শ্রবণকে সন্দেহ করেছে। নারীটির সদ্য পরিচিতা বান্ধবী চাঁদের থেকেও বেশী জ্বলেছিল। আকুল সরোদিয়া কেন, কেন নারী আকুল সরোদে? সরোদিয়া তার প্রেমিকের বন্ধু বন্ধু ভাই। সেও এমন তুতোকে ছুতোয় নাতায়…?
জানিনা। কথ্য নেই। আছে বিষণ্ণতা। সরোদিয়া আজ নাকি নারীর সদ্য পরিচিতা বান্ধবীকে নারীর নামে ডেকেছে। সরোদিয়ার বন্ধু একটি মেয়েকে অনেককাল, অনেককালই আবেশে বশে চায় প্রাকৃত তথ্য পেশ আমার এ। সেই মেয়ে চায় নিদাঘের তৃপ্তি এক ছেলের এলোমেলো বাউলে আউলে ভাবে, ব্যাঞ্জনায়।
কেউ কারোর হাত ধরে না,
রাত্রি বেড়েই চলে দুজনের মধ্যে
মহাজীবন যেমন বেড়েছে রাত্রির মতন বলে।
বলে তাই আমরা অবজ্ঞাত
রাত্রি অবসানে দিবস চাই।
নারী দিবস, শিশু দিবস, মে দিবস। কে কার বশ? দিবসকে জিততেই হবে রাত্রিকে হার। ফুলমালা নয় সে গলায় দুলিয়ে প্রেম! চাঁদের মতন অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ যদি। যদি বাউলে ছেলে গানের মীড়ে মীড়ে সরোদের মীড়ে মীড়ে কেউ মেয়েকে বা নারীকে রাত্রির মতন চাঁদের আশ্লেষ দিয়ে ্যায়, হে ধরিত্রী লিঙ্গবিদ্ধা ফসলে উবজায় যদি ধুলোবালি, ইকড়ি-মিকড়ি নীতিমালা অচ্ছেদ্দায় চাঁদমালা নাই যদি নাই হয় যদি বসন্ত ব্যাকুল কোকিলের রাত নেই যথা! সারাদিন শান্তিনিকেতনের ধুলোয় বসন্তের আবীরে, নারীটির অসুখ-শয্যার একান্তে বেড়েছে রাত্রি অন্ধকার।
দুই দল এখন পরস্পরের প্রতীক্ষার পরে পৃথক দুই গাছের নীচে ঘৃণা। জ্যোৎস্না জ্বালিয়ে দিচ্ছে মহাপট। বাকী সব অন্ধকার। আমি মাথা থেকে ঘুরতে ঘুরতে পায়ের গোছ অব্দি লাট্টু জ্যোৎস্না-থ। মাত্র দুটো গাছের দূরত্বের কথোপোকথন শ্রবণীয়।
– আমরা তো তোদের কাছেই এসেছিলাম। তোরা তো ডাকলিনা! চলে গেলি।
– আমরা তো দাঁড়িয়েই ছিলাম। তোমরাই তো বসে পড়লে।
– তোরা তো আমরা আসার পরেই কেমন সব চলে গেলি ওই গাছটার কাছে। কেউ আমাদের ডাকলোও না। একবারও।
– এ সবের মানে কি? আমরা তো আসবে বলেই ছিলাম। আলাদা ডাকতে হবে কেন?
– আমরা তো তোরা আছিস বলেই এসেছিলাম এখানে। তোরা চলে গেলি তো আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে।
– তোমরা তো ওখানেই বসে পড়লে।
– তোরাও তো বসতে পারতি এখানে।
– কালকে তো আমরা এই গাছের তলাতেই বসেছিলাম।
– আজকে এই গাছের তলাতে বসলে কি হত?
দুটো গাছের মধ্যেকার দূরত্ব একটার ছায়ার
অন্যকে ছুঁয়ে থাকার মধ্যেই দৃশ্যত প্রতিষ্ঠিত।
দুটো গাছের দূরত্বে তবু দুটো মোবাইল।
মোবাইল কথা বলছিল,
কেননা আমরা মোবাইল এই দোলে,
এই নারীদিবসের রাত্রিতে।
সংলাপের প্রথম বাক্যটি নারীর কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন-সহযাত্রিণী বান্ধবীর। পরের বাক্যটি সওয়াল-জবাবের – সরোদিয়ার বন্ধু, মেয়ে অভিলাষি পুরুষ হবার পাঠক্রমের ছেলে বহন করছিল মনন থেকে বাক্যে।
অনুক্রমে এমনই লিখিত
এই মুহুর্তবাক্যময়তার ফোটোকপি।
দুটো দল আজ। কাল ছিল এক
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বখেলার মাঠে।
দুটো দল, কিছু ছল, কিছু গরল, খোয়াই,
চাঁদ আমার, অন্ধকার আমার, রাত্রি আমার
একা একা আমি।
বসন্ত আমি কতকাল খুঁজছি।
দোল করবো খুব, কোন্দল না।
আমি খুব দুলবো রঙের ঢেউ-এ
মহাসমুদ্র হে অনিন্দ্য জীবন,
আমি খেলবো বলে কতকাল মাঠের ধারে,
তবু আমাকে দলে নিও না সকলে যা
সকালেই ফেলে যাবে নিশীথের
মালার মতন অবহেলায়।
জ্যোৎস্নার কিংখাব এমন ঢেকেছে চরাচর,
আমি মানুষের মুখ-চোখ, গাছের,
গাছেদের অবয়ব শুধু ছায়াসম
প্রত্যক্ষে উল্লসিত। আমার কেউ নেই
এমন যে দলের। কাঙ্খিত, কাঙ্খাকারিণী
মেয়েটি পাথরের মতন আমাদের প্রতীক্ষায় থেকে
আমাদের খোয়াই-এর ধারে রেখে চলে গ্যাছে
দলে দলে একা একা নারী ও পুরুষ ও
ছেলে ও মেয়েকে ও বালক ও বালিকা
রেখে আরো গভীর রাত্রের দিকে কষ্টের
এক বিছানায় অনেকক্ষণ তার চারদেওয়ালের
মধ্যে স্বেচ্ছায় কারাবন্দী হতে।
নারীটি অন্ধকার কোটর থেকে কষ্ট ঢালছিল
গলগল করে জ্যোৎস্নার শরীরে নিরবচ্ছিন্ন।
আমি উহাকে দেখিয়াছি। বাউলে কন্ঠটি শূণ্যতায়
মিলিয়েছে বাষ্পের মতন অসহ উত্তাপে অপারগতার।
কলকাতা-শান্তিনিকেতন সহযাত্রীণি বান্ধবী, নারীকে আলগা রেখে গা রেখেছে বাউলের সান্তনাকর্মে আলগা করে, যা সারাদিন চেয়েছিল জ্যোৎস্নার মতন অবিকল সে। সরোদের তারে বিশ্বস্ত আঙুল গম্ভীর ডোবার চেষ্টায় মগ্ন কুলকুল না চলা খোয়াই-এর ধারে।
ঝিঁ ঝিঁ পোকারা একনিষ্ঠ রাত্রির সংগীত,
সঙ্গতে স্তব্ধতাকে অবিলম্বিত লয়।
গাছের ছায়া আমাকে ছুঁয়ে নেই।
নারীটি প্রেতিনীর মতন জ্যোৎস্না-পায়চারি লিপ্ত।
সরোদ কিশোরি করেছিল যে মেলোডিকে কাল,
সে এখন কালান্তরে দুষছে নিজেকে-
কাউন্টার সিগারেটের ধোঁয়া গিলে,
যদি গিলে খেতে পারে যদি একটু
আকুলতা গিলে খেয়ে ও এক স্তব্ধতা
হতে পারে যা বিশীর্ণ খালটি বসন্তেও।
অনেক রাত্রিকে শেষ করে দিবস
যাপনে যে আমি ক্লান্ত বিন্দু মহাবিশ্বে
নিঃসঙ্গতার কড়ে আঙুল ছুঁয়ে দিবস,
বসন্ত, দোল, চাঁদ, খালপাড়, খোয়াইকে যে
রিক্ত দেখেছি সে কোনো দলের জার্সির মতন
নিজেকে কাটতে পারেনি বলে নারীটি, মেয়েটি,
ছেলেটি, বাউলে, সরোদিয়া, পরকীয়া,
সহযাত্রিণী সহযোগে এক্ষুণি একটা ট্রেন
ধরবে প্রান্তিক থেকে।
কেন্দ্রে যাবে না কোনোদিন যেমন নারীদিবস-ও।